Publish: Wednesday August 4, 2021 | 9:01 am  |  অনলাইন সংস্করণ

 dhepa 

ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা। ‘রাতের রঙ্গশালার রানি’। মডেলিংয়ের আড়ালে অপরাধ সাম্রাজ্যে বিচরণ তার। আন্ডারওয়ার্ল্ড কানেকশনে অস্ত্র কারবার থেকে শুরু করে মাদকের জমজমাট বাণিজ্যের অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। ধনাঢ্য পরিবারের সদস্যদের নিজের মাদকের আসরে ডেকে গোপন ছবি তুলে ব্ল্যাকমেইল করত সে। তার আসরে যাতায়াত করতেন দেশের বেশ কয়েকটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার। এমন তথ্য-প্রমাণ পেয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ।

পিয়াসার সঙ্গে বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি এখন বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভেসে বেড়াচ্ছে। আর মরিয়ম আক্তার মৌ ছিল তার সাম্রাজ্যের অন্যতম সহযোগী। অপরাধ সাম্রাজ্যের ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করতে মডেল পিয়াসা ও মৌকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পৃথক মাদক মামলায় তিন দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা শাখার যুগ্ম কমিশনার হারুন অর রশীদ যুগান্তরকে বলেন, পিয়াসার মাদক বাণিজ্যের বড় নেটওয়ার্ক রয়েছে। ওই নেটওয়ার্কে কারা জড়িত সে সম্পর্কে জানতে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এছাড়া পিয়াসার মাধ্যমে যারা ব্ল্যাকমেইলের শিকার হয়েছেন তারা অভিযোগ নিয়ে এলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পিয়াসার আসরে নামিদামি লোকজনের যাতায়াত থাকার কথাও জানিয়েছেন তিনি।

রোববার রাতে গ্রেফতারের পর সোমবার তাদের বিরুদ্ধে মাদক আইনে গুলশান ও মোহাম্মদপুরে পৃথক দুটি মামলা হয়। এরপর আদালতে উপস্থাপন করলে উভয়ের তিন দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর হয়। পুলিশের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের একটি টিম রাত ৯টা ২৫ মিনিটে বারিধারা এলাকা থেকে পিয়াসাকে এবং ওয়েব বেইজড ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিম রাত ১২টা ৫ মিনিটে মোহাম্মদপুর থানা এলাকা থেকে মৌকে গ্রেফতার করে। পিয়াসার কাছ থেকে ৭৮০ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট, বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ছয় লিটার মদ ও সিম্বা ব্র্যান্ডের ৪টি প্রিমিয়ার বিয়ার জব্দ করা হয়। আর মৌয়ের বাসা থেকে ৭৫০ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট ও বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ১২ লিটার মদ জব্দ করা হয়।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, আলিশান জীবনযাপন ছিল মডেল পিয়াসা ও মৌয়ের। নামিদামি ব্র্যান্ডের প্রসাধনী, দেশি-বিদেশি দামি পোশাক, শেলফের তাকে তাকে সাজানো জুতাসহ বাহারি সব পণ্যের সমাহার ছিল তাদের বাসায়। বাসার ভেতরে প্রবেশ করলে চোখ চড়কগাছ হওয়ার উপক্রম। কারণ তাদের দৃশ্যমান আয়ের উৎসের সঙ্গে জীবনযাপনের ব্যয়ের ছিল আকাশ-পাতাল ব্যবধান। গোয়েন্দাদের ভাষায়, পিয়াসার বাসা ছিল অনেকটা ‘রাজরানি’র ঘরের মতো।

যেখানে বিলাসী জীবনযাপনের জন্য সবই ছিল। ব্যবস্থা ছিল মনোরঞ্জনের। তারা বাসার মধ্যেই গড়ে তুলেছিলেন ‘মিনিবার’। যেখানে আনাগোনা ছিল ধনাঢ্য ব্যক্তিদের। সবচেয়ে বেশি যাতায়াত ছিল ধনীর দুলালদের। তাদের বাসায় এনে ছবি তুলে ব্ল্যাকমেইল করত দুই মডেল। নামিদামি বিভিন্ন ক্লাবের সদস্যপদ থাকার সুবাদে সেখানেও টার্গেট ঠিক করত তারা।

অভিযান সংশ্লিষ্টরা জানান, পিয়াসা নিজেকে অত্যন্ত প্রভাবশালী মনে করত। ফলে বাসায় ডিবি পুলিশ ঢোকার পর সে অনেকটা হতভম্ব হয়ে যায়। কারণ সে এটা ভাবতেও পারেনি যে, তার বাসায় পুলিশ যেতে পারে। এটা তার চিন্তার বাইরে ছিল। ফলে হতচকিত হয়ে কী করবে-বুঝে উঠতে পারছিল না সে। পরে গোয়েন্দাদের পক্ষ থেকে তাকে বলা হয়, ‘আমরা ডিবি থেকে আসছি, সহযোগিতা করুন।’ এরপর সে অনেকটা নিশ্চুপ হয়ে যায়। শুরু হয় তল্লাশি। সেখানে একটি মিনিবারের সন্ধান পাওয়া যায়। তার বাসায় মদের বারের ফুল সেটআপ ছিল। অভিযান শেষে যখন তাকে গাড়িতে তোলা হয়, তখন সে উচ্চস্বরে কয়েক ব্যক্তির নাম বলছিল।

ডিবি ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইনভেস্টিগেশনের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার মহিদুল ইসলাম বলেন, তার (পিয়াসা) বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ ছিল। এই মডেলের যেসব ডিভাইস জব্দ করা হয়েছে সেগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা হবে। তার বিরুদ্ধে আনা ব্ল্যাকমেইলের অভিযোগ নিয়েও কাজ চলছে। ভুক্তভোগীদের বক্তব্য ও গোয়েন্দা অনুসন্ধান অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ডিবি সূত্র জানায়, পিয়াসা ও মৌ একই সিন্ডিকেটে কাজ করে। পিয়াসা নিজেকে আরএম গ্রুপের পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের পরিচালক হিসেবে পরিচয় দেয়। এর বাইরে তার আয়ের বড় ধরনের কোনো উৎস পাওয়া যায়নি। আর মৌ বৈধ আয়ের কোনো উৎসই দেখাতে পারেনি। তবে তার স্বামী ও সে একাধিক ক্লাবের সদস্য।

গোয়েন্দা তথ্য ও যুগান্তরের অনুসন্ধানে জানা যায়, নানা অভিযোগের ভিত্তিতে পিয়াসার গতিবিধির ওপর নজর রাখছিলেন গোয়েন্দারা। তার অপরাধ নেটওয়ার্ক সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছিল। সুনিশ্চিত কিছু তথ্য পাওয়ার পরই রোববার রাতে বারিধারায় তার আলো ঝলমলে বাসায় অভিযান চালায় গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল।

গোয়েন্দা সূত্র আরও জানায়, পিয়াসার নেটওয়ার্কে ২০-২৫ জন সুন্দরী রমণী রয়েছে। পালাক্রমে তাদের মাধ্যমেই বসানো হয় মাদকের জমজমাট আসর। সেই আসরে আমন্ত্রণ জানানো হতো গুলশান, বনানী, বারিধারায় বসবাসকারী ধনাঢ্য ব্যবসায়ী, শিল্পপতি ও তাদের সন্তানদের। এতে তিন ধরনের ফায়দা হাসিল করত সে। আসরে আমন্ত্রিতদের বুঁদ করতে যে মাদক ব্যবহার করা হতো তার বিল পেত পিয়াসা। এছাড়া রমণীরা উদাম নৃত্যের সময় তাদের ওপর যে টাকা ছিটানো হতো তার বড় অংশও পিয়াসা নিত। আর গোপন ক্যামেরায় আসরে আগন্তুকদের ছবি তুলে ব্ল্যাকমেইল করত। এছাড়া রমণীদের সঙ্গে রাত কাটানো অতিথিদের পরদিন গুলশানের একটি ডায়মন্ড জুয়েলারি শপ থেকে লাখ লাখ টাকার জুয়েলারি উপহার দিতে বাধ্য করত। পরে ওই জুয়েলারি ফেরত দিয়ে নগদ টাকা নিয়ে নিত পিয়াসা।

তার সঙ্গে ওই ডায়মন্ড জুয়েলারি মালিকেরও ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। আর পিয়াসার নেটওয়ার্কে থাকা সদস্যদের ইয়াবার চালান আসত টেকনাফ থেকে। অভিনব কায়দায় সংগ্রহ করা হতো ওই চালান। যা গোয়েন্দাদের কাছেও অনেকটা অজানা। পিয়াসার ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা যায়, কয়েকজন বন্ধুর সহযোগিতায় একটি গরুর ফার্ম প্রতিষ্ঠা করেছে পিয়াসা। ওই ফার্মের জন্য টেকনাফ থেকে বার্মিজ গরু আনার সময় গরুর পেটে ঢুকিয়ে আনা হতো ইয়াবার চালান। এ কাজে পিয়াসার প্রধান সহযোগী হলো জনৈক জিসান ও জনৈক মিশু।

পিয়াসার সঙ্গে একজন আন্ডারওয়ার্ল্ড মাফিয়ারও ঘনিষ্ঠতার তথ্য এসেছে যুগান্তরের হাতে। ওই মাফিয়া চক্রের মাধ্যমে অস্ত্রের কারবার সিন্ডিকেটের ঘনিষ্ঠ হয় সে। ধনাঢ্য পরিবারের উঠতি বয়সি তরুণদের কাছে অবৈধ অস্ত্রের তথ্য আদান-প্রদানে কাজ করে সে। অত্যাধুনিক উজিগান হাতে পোজ দেওয়া পিয়াসার একটি ছবি এরই মধ্যে ভাইরাল হয়েছে। ওই অস্ত্রটি কার সে সম্পর্কে রিমান্ডে পিয়াসাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানিয়েছেন।

বারিধারার একজন ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে জানান, ২০১৫ সালে পিয়াসার ব্ল্যাকমেইলের শিকার হয় তার পরিবার। ফাঁদে ফেলে তার ছেলে সাফাতকে বিয়ে করে পিয়াসা। ৭-৮ মাসের সংসার জীবনে পিয়াসা নানাভাবে তার ছেলের কাছ থেকে বিলাসবহুল বিএমডব্লিউ গাড়িসহ প্রায় ৫ কোটি টাকার মালামাল হাতিয়ে নেয়।

এক পর্যায়ে আইনি সহায়তা নিয়ে তিনি গাড়িটি ফেরত আনেন। প্রতারণা বুঝতে পেরে পিয়াসাকে তালাক দিয়ে পরিবারে ফিরে আসে তার ছেলে। এতেই ক্ষিপ্ত হয় পিয়াসা। তালাকের তিন মাস পর বনানী রেইনট্রি হোটেলে সাফাতের জন্মদিনের পার্টিতে আসে দুই কলেজছাত্রী। পার্টির প্রায় দেড় মাস পর তা জানতে পেরে ধর্ষণের মামলা সাজায় পিয়াসা। সেই মামলায় দীর্ঘদিন কারাগারে থাকার পর জামিনে মুক্তি পায় সাফাত।

রোববার রাতে সাংবাদিক ব্রিফিংয়ে ডিবি পুলিশের যুগ্ম কমিশনার হারুন-অর রশীদ বলেন, দুজন (দুই মডেল) একটি সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্য। তাদের বিরুদ্ধে ব্ল্যাকমেইলিংয়ের অনেক অভিযোগ পেয়েছি। সেসব ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে তাদের বাসায় অভিযান চালানো হয়। দুজনের বাসায় বিদেশি মদ, ইয়াবা ও সিসা পাওয়া গেছে। মৌয়ের বাড়িতে মদের বারও ছিল। তিনি বলেন, গ্রেফতার হওয়া দুই মডেল হলো রাতের রানি। তারা দিনের বেলায় ঘুমায় এবং রাতে অশ্লীল কর্মকাণ্ড করে।

Array
We use all content from others website just for demo purpose. We suggest to remove all content after building your demo website. And Dont copy our content without our permission.
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

আর্কাইভ

October 2024
M T W T F S S
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
28293031